শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৭ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া : চকরিয়া উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বমুবিলছড়ি, লক্ষ্যারচর, ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নে দুই দশক ধরেই চলছে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ। ওইসব এলাকার গ্রামের ভেতরে বাড়ির আঙ্গিনায় স্থাপন করা হচ্ছে তামাক পোড়ানোর শত শত চুল্লি। মৌসুমের শুরুতে চুল্লিগুলোতে তামাক পোড়ানো কাজ শুরু করেছে কৃষকরা। চুল্লির বিষাক্ত ধোঁয়া বাতাসের সঙ্গে ছড়িয়ে গ্রামের বাড়িতে ঢুকছে। এতে গ্রামের মানুষ চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে। পাশাপাশি বসতবাড়িতে অগ্নিকান্ডের প্রবণতাও বাড়ছে।
পরিবেশ সচেতন মহলের মতে, দুই দশক আগে উপজেলার পাহাড়ি জনপদের সুরাজপুর-মানিকপুর ও বমুবিলছড়ি ইউনিয়নে সর্বপ্রথম তামাকের আগ্রাসন শুরু হয়। এরপর প্রতিবছর বাড়তে তাকে চাষের পরিধি। একইচিত্র চলছে কাকারা ইউনিয়নেও। পাশাপাশি এসব এলাকার গ্রামীণ জনপদে নিয়মনীতি না মেনে বাড়ির আঙিনা, ফসলি জমি ও বনের পাশে অসংখ্য তামাক চুল্লি গড়ে উঠেছে।
তামাক চাষিরা জানিয়েছে, চকরিয়ার বিভিন্ন ইউনিয়নে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিকর অন্তত ৬০০ তামাক চুল্লির মধ্যে চারশটি বসতবাড়ি আঙ্গিনা কিংবা খেতের পাশে অবস্থিত। ইতিমধ্যে এসব চুল্লিতে তামাক পোড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে। তামাক চুল্লিগুলোতে প্রতিদিন কয়েক হাজার মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। চুল্লির জ্বালানি হিসেবে সংরক্ষিত বন থেকে অধিকাংশই কাঠ আসছে।
উপজেলা কৃষি কার্যালয় ও তামাক কোম্পানি সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চকরিয়ায় এ বছর ১ হাজার ৮৫৫ একর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বমুবিলছড়ি, ফাঁসিয়াখালী, লক্ষ্যারচর ইউনিয়নে এসব তামাক চাষ হয়। দুইটি তামাক কোম্পানির নিবন্ধিত ৮৫২জন কৃষক রয়েছে। তিন একর জমির তামাক পোড়াতে একটি তামাক চুল্লি লাগে। সে হিসাবে উপজেলায় ছয় শতাধিক তামাক চুল্লি আছে।
মাঝেরফাঁড়ি এলাকার এক তামাক চাষি বলেন, ‘প্রায় চার একর জমিতে চলতি বছর তামাক চাষ করেছি। চুল্লি করতে জমি বর্গা নিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। খরচ বাঁচাতে তিনি বাড়ির আঙিনায় তামাকের চুল্লি স্থাপন করেছেন। মাঝেরফাঁড়িতে এই রকম আরও অর্ধ শতাধিক চুল্লি রয়েছে বলে তিনি জানান।’
লোকালয় থেকে তামাক চুল্লি অপসারণ করতে কাকারা ইউনিয়নের জনসাধারণের পক্ষে সমাজকর্মী আকতার মারুফ চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবর লিখিত দরখাস্ত দিয়েছে। কাকারা ইউনিয়নের বাসিন্দা আকতার মারুফ বলেন, ‘অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই গ্রামের মানুষ তামাকের বিষাক্ত ছোবলে ক্ষত-বিক্ষত। গ্রামের ফসলি জমি এখন তামাকের দখলে। এমনকি নদীর তীরও আগ্রাসন থেকে বাদ নাই। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হল তামাক পোড়ানোর চুল্লিগুলো ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয়ে স্থাপন করা হয়েছে। চুল্লি থেকে যে পরিমাণ বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয় তা অবিশ্বাস্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিষাক্ত ধোঁয়ার কারণে শিশু ও বৃদ্ধদের শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। তামাকের কটু গন্ধে ঘরে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। তামাক পাতা কাটা ও পোড়ানোর কাজে চাষিরা নারী ও শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। যা অমানবিক। নারী-শিশুদের কম মজুরি দিতে হয় তাই তাদের খাটায় চাষিরা। এতে শিশুরা প্রাথমিক পর্যায় শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়ছে।’
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, ‘তামাক চাষ কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। চাষিরা বেশিভাগ গরীব। তাঁরা দাদনদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে কৃষকরা, এতে তারা তামাক চাষ করে লাভবানও হচ্ছে না।’
চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস.এম. নাসিম হোসেন বলেন, ‘তামাক চাষের কুফল সম্পর্কে বিভিন্ন উঠান ও মাঠ বৈঠকের কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এতে এই বছর অন্য বছরের তুলনায় ১০৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়নি। তারা এসব জমিতে সবজি, সরিষা ও ফুল চাষ করেছে।’
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা বলেন, ‘তামাক কৃষি পণ্য। যেকোন চুল্লি স্থাপনে পরিবেশের ছাড়পত্র নিতে হয়, তামাক চুল্লি স্থাপনে কাউকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। বায়ুদূষণ যেন না হয় সেই জন্য কৃষকদের সচেতন হতে হবে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply